মূল বিষয়ে যান
  1. উপন্যাস/
  2. দার্জিলিং জমজমাট (১৯৮৬)/

দার্জিলিং জমজমাট (১৯৮৬) - ১১

11 #

পরদিন সকাল সাতটায় আমাদের হোটেলের ঘরের ফোনটা বেজে উঠল। আমরা দুজনেই আগেই উঠে পড়েছিলাম, সবে বেড-টি খাওয়া হয়েছে, ফেলুদা বিছানায় বসেই হাত বাড়িয়ে ফোনটা তুলল। ওকে শুধু দুটো কথা বলতে শুনলাম—বলেন কী! আর আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে নিচ্ছি।

ফোনটা রেখে আমার দিকে ফিরে বলল, লালমোহনবাবুকে বল তৈরি হয়ে নিতে—এক্ষুনি!

কী ব্যাপার, কোথায় যাওয়া হচ্ছে? সেটা পুলিশের জিপে উঠে বুঝলাম। আজ সক্কাল সক্কাল পুলিশের জিপ নয়নপুর ভিলায় গিয়েছিল ওদের মিটিং সম্বন্ধে খবর দিতে। গিয়ে শুনল সমীরণবাবু নাকি একটা জরুরি টেলিফোন পেয়ে পনের মিনিট আগে শিলিগুড়ি রওনা হয়ে গেছেন। অথচ ফেলুদার মতে মিটিং-এ তাঁকে ছাড়া চলবে না।

পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে এই স্পিডে কোনও দিন চলেছি বলে মনে পড়ে না। দেখতে দেখতে ঘুম সোনাদা টুং ছড়িয়ে গেল। তবু ভাগ্যি ভাল এখন অবধি তেমন কুয়াশা পাইনি। নইলে জিপের স্পিড তোলা যেত না। অসম্ভব তুখোড় ড্রাইভার, তাই পঁয়তাল্লিশ মিনিটের রাস্তা আধা ঘণ্টায় পেরিয়ে গেল।

সাহা অবিশ্যি কার্সিয়ং আর শিলিগুড়িতেও খবর পাঠিয়ে দিয়েছিলেন যাতে সমীরণবাবুর গাড়ি তারা আটকায়। কিন্তু ট্যাক্সির নম্বরটা দেওয়া সম্ভব হয়নি। সেটা বার করতে বেশ কিছুটা সময় নষ্ট হয়ে যেত।

কার্সিয়ং পর্যন্ত গিয়েও সমীরণবাবুর ট্যাক্সির কোনও পাত্তা পাওয়া গেল না। সাহা ড্রাইভারকে বললেন, এবার পাংখাবাড়ির শর্টকাটটা ধরো।

আমাদের দুটো জিপ ছিল; একটা সাধারণ রাস্তা দিয়ে গেল, আর অন্যটা—যাতে আমরা g য়ছি–সেটা শর্টকাটটা ধরল।

পাংখাবাড়ির রাস্তা যে কী ভয়ানক প্যাঁচালো, সেটা যে না দেখেছে তাকে বোঝানো অসম্ভব। লালমোহনবাবু তো চোখ বন্ধ করে রইলেন। বললেন, অন্য গাড়ির দেখা পেলে বোলো, তপেশ। আমি তার আগে আর চোখ খুলছি না; খুললেই গা গুলোবে।

পনের মিনিট সাপের মতো প্যাঁচানো উতরাই দিয়ে যাবার পর একটা হেয়ারপিন বেন্ড ঘুরেই দেখা গেল একটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তার প্রায় মাঝামাঝি। বাঝাই যাচ্ছে টায়ার পাংচার। গাড়ির পাশে রাস্তায় দাঁড়িয়ে অসহিষ্ণুভাবে সিগারেট টানছেন সমীরণ মজুমদার।

আমাদের জিপ দেখেই ভদ্রলোক কেমন যেন হকচাকিয়ে তটস্থ হয়ে পড়লেন।

আমরা সকলেই গাড়ি থেকে নামলাম। ফেলুদা আর সাহা এগিয়ে গেল সমীরণবাবুর দিকে। ভদ্রলোকের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।

কী— কী ব্যাপার?

কিছুই না, বলল ফেলুদা, হয়েছে কী, আপনি যে মিটিংটা অ্যাটেন্ড করতে যাচ্ছেন কলকাতা, তার চেয়েও ঢের জরুরি মিটিং রয়েছে আজই, সকাল দশটায় আপনাদের নয়নপুর ভিলাতে। সেখানে আপনার থাকা একান্তই প্রয়োজন। অতএব আর বাক্যব্যয় না করে আপনার ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে উঠে পড়ুন আমাদের জিপে। সঙ্গে আপনার সুটকেসটাও অবিশ্যি নেওয়া চাই।

তিন মিনিটের মধ্যে আমরা আবার রওনা হলাম। উলটা মুখে। পথে কোনও কথা হল না। ফেলুদা চুপ, সাহা চুপ, সমীরণবাবুও চুপ।

নয়নপুর ভিলা যখন পৌঁছলাম তখন পৌনে দশটা।

বাড়ির ভিতর ঢুকে ফেলুদা সমীরণবাবুকে বলল, আপনার লোকনাথ বেয়ারা যখন আর নেই, তখন আপনার অন্য চাকর বাহাদুরকে বলুন কফি করতে। অন্তত কারো কাপ।

আমরা বৈঠকখানায় গিয়ে বসলাম। পাশের ঘর থেকে আরও চেয়ার এনে রাখা হয়েছে। সবাই যাতে বসতে পারে।

কফি আসার সঙ্গে সঙ্গেই এভারেস্ট হোটেলের দলও চলে এল। পুলক ঘোষাল, একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করল, ব্যাপার কী লালুদা?

লালমোহনবাবু বললেন, তুমি যেই তিমিরে, আমিও সেই তিমিরে। তবে যতদূর জানি, রহস্যে আলোকপাতের জন্যেই এই মিটিং-এর ব্যবস্থা। আলোকসম্পাত করবেন। শ্ৰীপ্ৰদোষ মিত্ৰ।

আমাদের শুটিং আবার চালু করতে পারব তো?

সে তো ভাই বলতে পারব না। কিছুক্ষণের মধ্যেই জানতে পারবে।

দুগ্‌গা দুগ্‌গা!…বারো বছর এ লাইনে আছি, সতেরোখানা ছবি ডাইরেক্ট করেছি, কিন্তু এ হুজতে পড়িনি কখনও।

পুলক ঘোষীলের কচুমাচু ভাব দেখে আমার মায়া হল। ছাপ্পান্ন লাখ খরচ হবার কথা ছবিটাতে। সেটা এখন বেড়ে গিয়ে কোথায় দাঁড়াবে কে জানে?

সবাই চেয়ার বেছে নিয়ে বসে পড়ল। সকলেরই অস্বস্তি ভাব। আমি একবার সকলের উপর চোখ বুলিয়ে নিলাম। আমার ডাইনে বসেছেন। লালমোহনবাবু, আর বাঁয়ে ফেলুদা। ফেলুদার পরে পর-পর গোল হয়ে বসেছেন ইনস্পেক্টর সাহা, সমীরণবাবু, রজতবাবু, পুলক ঘোষাল, মহাদেব ভার্মা, রাজেন্দ্র রায়না। আর ক্যামেরাম্যান সুদেব ঘোষ। এ ছাড়া ঘরে দাঁড়িয়ে আছে নেপালি চাকর বাহাদুর, রান্নার লোক জগদীশ, আর চারজন কনস্টেবল। চারজনই রয়েছেন ঘরের দরজার মুখটাতে।

আমাদের কফি খাওয়া শেষ হল। শেলফে রাখা একটা বাহারের ঘড়িতে টিং টিং করে দশটা বাজল। আর তার সঙ্গে সঙ্গেই ফেলুদা উঠে দাঁড়াল। সমস্ত ঘরে একমাত্র ফেলুদার মধ্যেই কোনও অস্বস্তির ভাব নেই। ইনস্পেক্টর সাহাকেও একবার আঙুল মটকাতে লক্ষ করেছি।

বোম্বাইয়ের অভিনেতা দুজন রয়েছে বলে ফেলুদা ইংরিজিতে কথা বলল, আমি সেটা বাংলা করে লিখছি।

ফেলুদা আরম্ভ করল—

গত ক’দিনে এ বাড়িতে কয়েকটা দুৰ্ঘটনা ঘটে গেছে। সাধারণ অবস্থায় হয়তো ঠিক এইভাবে এগুলো ঘটত না, কিন্তু এ বাড়িতে একটা ফিল্মের শুটিং চলাতে দৈনন্দিন রুটিনে কিছু পরিবর্তন দেখা দিয়েছিল, এবং অনেক লোকের মনই পড়ে ছিল এই শুটিং-এর দিকে-যার ফলে কতকগুলি ঘটনা ঘটা সম্ভব হয়েছিল।

প্রধান ঘটনা হল-বাড়ির যিনি কর্তা-বিরূপাক্ষ মজুমদার-তিনি খুন হন। আমি নিজে একজন প্রাইভেট ইনভেসটিগেটার; আমার কাছে হত্যাটা খুব রহস্যজনক বলে মনে হচ্ছিল। খুনের প্রধান উদ্দেশ্য যদি মূল্যবান জিনিস চুরি হয়ে থাকে, তা হলে লোকনাথ বেয়ারার উপর সন্দেহ পড়াটা খুব স্বাভাবিক, কারণ সে খুনের পর থেকেই উধাও হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আমার মন এটা মানতে চাইছিল না-কেন, সেটা ক্রমে প্রকাশ করছি। প্রথমে, যিনি খুন হয়েছিলেন তাঁকে জড়িয়ে দুটো ঘটনা আমি আপনাদের বলতে চাই।

একটা ঘটে যখন তিনি কলকাতায় বেঙ্গল ক্যাঙ্কের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ছিলেন। ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টের একটি তরুণ কর্মচারী-নাম ভি, বাল্যাপোরিয়া-তহবিল তছরূপ করে প্রায় দেড় লাখ টাকা হাত করে বেপাত্তা হয়ে যায়। আজ পর্যন্ত তার কোনও সন্ধান পাওয়া যায়নি।

দ্বিতীয় ঘটনা ঘটে মধ্যপ্রদেশের নীলকণ্ঠপুরে। ওখানকার রাজা পৃথ্বী সিং-এর আমন্ত্রিত হয়ে বিরূপাক্ষ মজুমদার সেখানে যান বাঘ শিকার করতে। সেখানে জঙ্গলে ঝোপের পিছনে বাঘ ভেবে তিনি একটি মানুষের উপর গুলি চালান। তার ফলে সেই মানুষের মৃত্যু হয়। যিনি মরেন তিনি ছিলেন বাঙালি। নাম সুধীর ব্ৰহ্ম। নীলকণ্ঠপুর রাজ কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন। তাঁর একটি শখ ছিল, সেটা হল কবিরাজি গাছ-গাছড়া সংগ্ৰহ করা। এই কাজ করতেই তিনি জঙ্গলে গিয়েছিলেন, এবং এই জন্যই তাঁর মৃত্যু হয়। এই হত্যার খবর যাতে সম্পূর্ণ গোপন থাকে, তার জন্য পৃথ্বী সিংকে অনেক টাকা খরচ করতে হয়।

যিনি মারা গিয়েছিলেন, সেই সুধীর ব্রহ্মের একটি ছেলে ছিল, নাম রমেন ব্রহ্ম। স্বভাবতই রমেন ব্ৰহ্ম এই ঘটনায় খুবই বিচলিত হয়ে পড়েন। তখন তাঁর বয়স ছিল ষোল। তিনি প্রতিজ্ঞা করেন যে, বড় হয়ে তিনি এই অন্যায়ের প্রতিশোধ নেবেন। এখানে বলে। রাখি, এই ঘটনা আমি শুনি দাৰ্জিলিং-এর বাসিন্দা এবং মিঃ মজুমদারের প্রতিবেশী হরিনারায়ণ মুখোপাধ্যায়ের কাছে, যিনি সেই সময় নীলকণ্ঠপুরে থাকতেন এবং সুধীর ব্রহ্মের পরিবারকে চিনতেন। এই ঘটনার অবিশ্যি কোনও প্রমাণ নেই, কিন্তু তাঁর জীবনে যে একটা কলঙ্কময় ঘটনা ঘটেছিল এবং সেটা যে খবরের কাগজ থেকে চেপে রাখা হয়েছিল সে ইঙ্গিত বিরূপাক্ষ মজুমদার নিজেই আমাকে দিয়েছিলেন। সুতরাং এটা অবিশ্বাস করার কোনও কারণ আমি দেখি না।

এবার বিরূপাক্ষবাবুর হত্যার ঘটনায় আসা যাক। তাঁকে মারবার কারণ ও সুযোগ কর থাকতে পারে এটা ভাবতে গেলে প্রথমেই মনে হয় তাঁর ছেলে সমীরণবাবুর কথা। সমীরণবাবু শেয়ার মার্কেটে অনেক লোকসান দিয়েছেন এ খবর আমরা পেয়েছি। এটা কি সমীরণবাবু অস্বীকার করতে পারেন?

সমীরণবাবু মাথা নেড়ে না বললেন, তাঁর দৃষ্টি মেঝের কার্পেটের দিকে!

আর তিনি যে তাঁর পিতার মৃত্যুতে আর্থিক দিক দিয়ে বিশেষ লাভবান হলেন সেটা কি তিনি অস্বীকার করতে পারেন?

সমীরণবাবু এবারও মাথা নেড়ে না বললেন।

ভেরি গুড, বলল ফেলুদা। এবার আমরা খুনের চেহারাটা দেখব।

বিরূপাক্ষবাবু দুধে মিশিয়ে টক্রানিল বলে একটা বড়ি খেয়ে দুপুরে ঘুমোতেন। এই দুধ তাঁকে এনে দিত তাঁর বেয়ারা লোকনাথ। এই বড়ি মৃত্যুর দু দিন আগে পুরো এক মাসের স্টক, অৰ্থাৎ একত্ৰিশটা, কেনেন বিরূপাক্ষবাবু; তখন আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। খুনের পর দেখা যায় যে তার একটিও অবশিষ্ট নেই। আমাদের স্বভাবতই মনে হবে যে এই বড়িগুলির সবই তাঁর দুধের সঙ্গে মেশানো হয়েছিল। ত্ৰিশটা টাফ্লানিল একসঙ্গে খেলে একজন মানুষের মৃত্যু হতে পারে। আমাদের ধারণা আরও বদ্ধমূল হয় এই দেখে যে, বিরূপাক্ষবাবু একটা কাগজে কাঁপা হাতে বিষ কথাটা লিখে রেখে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেই সঙ্গে আরেকটা ব্যাপার দেখা গেল। এই যে, তাঁকে যে শুধু বড়ি খাওয়ানো হয়েছিল তা নয়। সেই সঙ্গে তাঁকে ছোরাও মারা হয়েছিল। এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, বিষ কথাটা লেখার পরে তাঁকে ছোরা মারা হয়েছিল। মনে হয়, বড়িতে কাজ দেবে না মনে করে আততায়ী পরে আরেকবার এসে ছোরা মেরে খুনকে আরও নিশ্চিন্তভাবে সম্পন্ন করে।

এখানে প্রশ্ন আসে—এই খুনের মোটিভ কী? এরও উত্তর পেতে কোনও অসুবিধা হয়নি। বিরূপাক্ষবাবুর ঘরে অষ্টধাতুর একটি মহামূল্য মূর্তি ছিল। সেটি এই খুনের সঙ্গে সঙ্গে উধাও হয়ে যায়।

এখানে আমার মনে খটকা যাই থাকুক না কেন, পুলিশের বিশ্বাস হয় যে বেয়ারা লোকনাথ মূর্তিটা হাত করার জন্য মনিবকে ত্ৰিশটা বড়ি খাইয়ে তারপর খুনটাকে আরও জোরদার করার জন্য তাঁর বুকে ছুরি মেরে মূর্তিটাকে নিয়ে পালায়। গতকাল কিন্তু জানা যায় যে এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। আমার বন্ধু মিঃ গাঙ্গুলী ও ভাই তপেশ গতকাল বিকেলে এই বাড়ির পিছনের ঝাউবনে বেড়াতে গিয়ে অকস্মাৎ লোকনাথ বেয়ারার মৃতদেহ আবিষ্কার করে। তাকেও ছুরি মেরে খুন করা হয়েছে। শুধু তাই নয়; মৃতদেহের পাশে ছড়ানো ছিল খান ত্ৰিশোক টিফানিলের বড়ি। অথাৎ লোকনাথ শুধু যে খুন, বা চুরি করেনি তা নয়, যাতে তার মনিবকে বড়ি খাইয়ে হত্যা না করা হয়, সেইজন্য সে বড়িগুলো নিয়ে পালাচ্ছিল। সেই সময় কেউ তাকে খুন করে।

অর্থাৎ এও জানা যাচ্ছে যে বিরূপক্ষ মজুমদারের মৃত্যু হয় একমাত্র ছুরির আঘাতেই, বড়ি খেয়ে নয়।

ইতিমধ্যে আমার নিজের কতকগুলো অভিজ্ঞতা হয় যে-সম্বন্ধে আমি আপনাদের বলতে চাই।

নিয়নপুর ভিলার একজন বাসিন্দা হিসাবে রজত বাস সম্বন্ধে আমার একটা কৌতুহল ছিল, যদিও প্রথম দিকে তাঁর উপর সন্দেহ পড়ার কোনও কারণ ছিল না। তাঁকে জেরা করে আমি জানতে পাই যে, তিনি ফিফটি সেভানে বি কম পাশ করেন।

এ ব্যাপারে আমরা অনুসন্ধান করে জেনেছি যে, রজত বোস নামে কোনও ছাত্র ওই বছর বি কম পাশ করেনি।

আমি রজতবাবুর দিকে চাইলাম। তিনি হঠাৎ যেন কেমন মুষড়ে পড়েছেন। ফেলুদার দৃষ্টি তখন রজতবাবুর দিকে। সে বলল, এই গোলমালটা কেন হল বলতে পারেন?

রজতবাবু দুবার গলা খাকরে চুপ করে গেলেন। তারপর যেন নিজের মনকে শক্ত করে একটা বড় রকম নিশ্বাস টেনে নিয়ে বললেন, আমি বিরূপাক্ষ মজুমদারকে খুন করিনি, কিন্তু করতে চেয়েছিলাম-একশোবার চেয়েছিলাম। হি কিলড মাই ফাদার। তারপর ঘুষ দিয়ে লোকের মুখ বন্ধ করেন। হি ওয়াজ এ ক্রিমিন্যাল!

ফেলুদা বলল, সে ব্যাপারে আপনার উপর আমার সহানুভূতি আছে। কিন্তু এবার আমি আপনাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই––সত্যি কি মিথ্যে বলুন।

কী কথা?

রজতবাবু এখনও হাঁপাচ্ছেন।

ফেলুদা বলল, সে দিন লোকনাথ রোজকার মতো দুধে বড়ি মিশিয়ে তার মনিবকে খবর দিতে গিয়েছিল। মজুমদার সেই সময় শুটিং দেখছিলেন। তখন দুধের গেলাস আর বড়ির বোতল খাবার ঘরে পড়ে ছিল। আপনি সুযোগ বুঝে দুধে আরও বেশি করে বড়ি মেশাতে গিয়েছিলেন-তাই নয় কি?

রজতবাবু বললেন, আমি তো বলেইছি—আমি আমার বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলাম।

কিন্তু আপনি কাজটা করার আগেই ঘরে লোকনাথ ফিরে আসে-ঠিক কি না? এবং সে আপনাকে ওখানে ওইভাবে দেখে সমস্ত ব্যাপারটা আঁচ করে। আপনি তার মুখ বন্ধ করতে বদ্ধপরিকর হন।

হি ওয়াজ এ ফুল! কেঁচিয়ে উঠলেন রজতবাবু। আমি ওকে দলে টানতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ও রাজি হয়নি।

তাই আপনি তাকে আক্রমণ করেন। সে আপনার হাত থেকে মুক্তি পেয়ে বড়ি সমেত বোতল নিয়ে ঝাউবনে পালায়। আপনি তার পিছু নেন; আপনার সঙ্গে অস্ত্র ছিল—মিঃ জুমদারের পেপার কাটার। আপনি তাকে ধরে ফেলেন, কিন্তু আপনি ছুরি মারার আগে সে তার হাতের বোতল মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।

এতক্ষণ দৃঢ়ভাবে থাকলেও রজতবাবু হঠাৎ ভেঙে পড়ে দু হাতে মুখ গুঁজে নিলেন।

দুজন কনস্টেবল তাঁর দিকে এগিয়ে গেল।

আর একটা ছোট্ট প্রশ্ন, কলাল ফেলুদা, আপনার সুটকেসে যে আর বি লেখা আছে, সেটা তো আসলে রমেন ব্ৰহ্ম, এবং সেই জন্যেই পরে রাজত বোস নাম নিয়েছিলেন?

রজতবাবু মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললেন।

ফেলুদা আবার তার কথা শুরু করল।

এর মধ্যে গতকাল আবার একটা ঘটনা ঘটে। একজন লোক কুয়াশার মধ্যে আমাকে খাদে ফেলে মারতে চেষ্টা করে।

সমস্ত ঘর চুপ। সকলেই ফেলুদার দিকে চেয়ে আছে। ফেলুদা বলে চলল—

লোকটিকে ভাল করে দেখা যায়নি কুয়াশার জন্য, তবে তার চাপ দাড়িটা যে কৃত্রিম, সেটা সন্দেহ করেছিলাম। সে লোকটি যখন আমাকে ঠেলা মারে তখন আমি একটা সেন্টের গন্ধ পাই। সেটা ছিল। ইয়াৰ্ডলি ল্যাভেন্ডার এবং সে গন্ধ আমি আরেকবার একজনের গায়ে পেয়েছিলাম।–দমদম এয়ারপোর্টে রেস্টোরান্টে বসে।

এখানে হঠাৎ রাজেন রায়ন কথা বলে উঠল।

আমি নিজে ইয়ার্ডলি ল্যাভেন্ডার ব্যবহার করি, কিন্তু মিস্টার মিত্তির যদি বলেন যে আমি ছাড়া সে সেন্ট কেউ ব্যবহার করে না, তা হলে তিনি অত্যন্ত ভুল করবেন।

ফেলুদার ঠোঁটের কোণে হাসি।

আপনি যে এ কথা বলবেন তা আমি জানতাম, বলল ফেলুদা। কিন্তু আমার কথা বলা তো এখনও শেষ হয়নি, মিঃ রায়না।

বলুন কী বলবেন।

ফেলুদা এবার সাহার কাছ থেকে একটা পোর্টফোলিও নিয়ে তার ভিতর থেকে একটা খাম বার করল। আর সেই সঙ্গে একটা বাঁধানো ছবি। এটা সেই বেঙ্গল ব্যাঙ্কের গ্রুপ ফোটো।

এই গ্রুপ ছবিটার কথা কি আপনার মনে আছে, মিঃ রায়না?

আই হ্যাভ নেভার সিন ইট বিফোর।

কিন্তু এতে যে আপনি নিজে উপস্থিত রয়েছেন।

মানে?

এইবার ফেলুদা খাম থেকে একটা ছবি বার করল। এটা একটা মুখের এনলার্জমেন্ট।

এই ছবিটার উপর আমার একটু কলম চালাতে হয়েছে, বলল ফেলুদা, কারণ তখন আপনার দাড়ি ছিল না, এখন হয়েছে। দেখুন তো এঁকে চিনতে পারেন কিনা। এটা বেঙ্গল ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টের ভি. বাল্যাপেরিয়ার ছবি।

রায়না আর হাতে নিয়ে ছবিটা দেখল না। সে একটা রুমাল বার করে ঘাম মুছছে। আমি দেখতে পাচ্ছি। ছবিটার সঙ্গে রায়নার হুবহু সাদৃশ্য।

যাঁর বাড়িতে আপনার শুটিং হবে তিনি যে আপনার এককালের বস, এবং তিনি যে আপনাকে চিনে ফেলবেন এটা আপনি কী করে জানবেন? আর, একবার যদি সত্য কথা প্রকাশ পেয়ে যায় তা হলে সেই কলঙ্কের চাপে আপনার ফিল্ম কেরিয়ারের কী দশা হবে সেটা তো। আপনি বুঝতেই পারছিলেন। মিঃ মজুমদার আপনাকে জানিয়েছিলেন যে তিনি আপনাকে চিনতে পেরেছিলেন। আপনি অস্বীকার করেন। তাতে তিনি বলেন, ইউ আর এ লায়ার! আর তারপর বাংলায় বলেন, আমি তোমার একটা কথাও বিশ্বাস করি না। আপনি এগারো বছর বেঙ্গল ব্যাঙ্কে চাকরি করেন, কাজেই আপনি বাংলা যথেষ্ট ভাল ভাবেই জানতেন।

আর খুনের সুযোগের কথাই যদি হয়, তা হলো লাঞ্চের সময় পঁয়তাল্লিশ মিনিট কাজ বন্ধ ছিল; সেই ফাঁকে মিঃ মজুমদারের ঘরে যাওয়া আপনার সম্ভব ছিল; আর মিঃ মজুমদার যখন আপনাদের তাঁর বালগোপালকে দেখাতে নিয়ে যান, তখন তার পাশেই যে একটি ভুজালি রয়েছে সেটা নিশ্চয়ই আপনার দৃষ্টি এড়ায়নি।

সাহা এবার রায়নার দিকে রওনা দিলেন। পুলক ঘোষাল মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। তাঁর মনের কী অবস্থা সেটা আমি বেশ বুঝতে পারছি। লালমোহনবাবু এবার আমার দিকে ঝুকে পড়ে ফিসফিস করে বললেন, কিন্তু মজুমদার বিষ কথাটা কেন লিখলেন–

লালমোহনবাবুর কথা শেষ হল না, কারণ ফেলুদা আবার মুখ খুলেছে। সে বলল—

আমি আরও বলছি, মিঃ রায়না। মিঃ মজুমদারকে যখন আপনি খুন করতে যান, তখন তাঁর ঘুম ভেঙে যায়। তিনি আপনাকে দেখেছিলেন। ছুরির আঘাতের পরও তিনি কয়েক মুহূর্ত বেঁচে ছিলেন। কারণ ছুরি ঠিক, মোক্ষম জায়গায় লাগেনি। মিঃ মজুমদার আপনার নামটা লিখে যেতে চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু পুরোটা লিখতে পারেননি। সে নামটা কী আপনি বলবেন?–রায়না চুপ।

আমি বলি?

রায়না চুপ।

আমরা খবর নিয়ে জেনেছি যে, ভি বাল্যাপোরিয়া হচ্ছে বিষ্ণুদাস বাল্যাপেরিয়া। বিষ্ণুদাসের বিষ-টুকু মজুমদার লিখতে পেরেছিলেন, আর পারেননি।

আই অ্যাম সরি, আই অ্যাম সরি! বলে ডুকরে কেঁদে উঠলেন বিষ্ণুদাস বাল্যাপেরিয়া ওরফে রাজেন রায়না।

ফেলুদা এবার সমীরণবাবুর দিকে চাইল। সমীরণবাবু বললেন, আমি তো এদের কাছে শিশু!

তা বটে, বলল ফেলুদা।এবার সুটকেসটা খুলুন তো দেখি; খুলে অষ্টধাতুর বালগোপালটা বার করে দিন।

বিকেলে কেভেনটারসের ছাতে বসে কথা হচ্ছিল। আমরা তিনজন আর পুলক ঘোষাল।

দাৰ্জিলিংটা বড় অপয়া জায়গা, লালুদা, বললেন পুলক ঘোষাল। তার চেয়ে ভাবছি, সিমলায় করব শুটিং-টা। রাজেন রায়নার জায়গায় অর্জুন মেরহাত্ৰা। কেমন মানাবে?

দুর্দান্ত, বললেন লালমোহনবাবু। তবে আমার অংশটা বাদ পড়বে না তো!

পাগল!—নভেম্বরেই শুটিং আরম্ভ করে ফেলব, আর ফেব্রুয়ারিতে শেষ। আরও চারখানা ছবি আছে আমার হাতে, সব এইটি সেভেনের মধ্যে নামিয়ে দিতে হবে।

চারখানা ছবি! পর পার?

তা আপনাদের আশীর্বাদে মোটামুটি চলছে ভালই, লালুদা!

ফেলুদা লালমোহনবাবুর দিকে ফিরে বলল, এঁকেও তা হলে এ বি সি ডি বলা চলে, তাই না?

কীরকম? চোখ কপালে তুলে জিজ্ঞেস করলেন জটায়ু।

এশিয়াজ বিজিয়েস্ট সিনেমা ডাইরেক্টর।