মূল বিষয়ে যান
  1. উপন্যাস/
  2. রয়েল বেঙ্গল রহস্য (১৯৭৪)/

রয়েল বেঙ্গল রহস্য (১৯৭৪) - ১২

12 #

জোড়া বন্দুকের গুলির আওয়াজে উত্তরদিকের গ্রাম থেকে লোকজন ছুটে এসেছে। তারা মহা ফুর্তিতে বাঘটাকে মন্দিরের ও পাশে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে, বাঁশের সঙ্গে বেঁধে কাঁধে তোলার আয়োজন করছে। এটাই যে মানুষখেকো তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আরও দুটো গুলির চিহ্ন বাঘের গায়ে পাওয়া গেছে; একটা পিছনের পায়ে, আর একটা চোয়ালের কাছে। এর যে কোনও একটার ফলে বাঘ তার স্বাভাবিক শিকারের ক্ষমতা হারিয়ে মানুষের পিছনে ধাওয়া করতে পারে। বাঘটার বয়সও যে বেশি সেটা তার গালের দু পাশের ঘন লোম থেকেই বোঝা যায়।

পৰ্ব্বত সিং ফিরে এসেছে। সে মহীতোষবাবুর হাত ধরে তুলে তাঁকে মন্দিরের ভাঙা সিঁড়ির উপর বসিয়ে দিয়েছে। ভদ্রলোক এখনও ঘন ঘন ঘাম মুছছেন। লালমোহনবাবুর জ্ঞান ফিরেছে। গাছ থেকে নামটা তাঁর পক্ষে ওঠার মতো সহজ হয়নি, আমার সাহায্য নিতে হয়েছে। নেমে এসেই, যেন কিছু হয়নি এমন ভাব করে আমার হাত থেকে তলোয়ারটা আবার নিয়ে নিয়েছেন।

কিছুক্ষণ চুপচাপের পর ফেলুদা কথা বলল।

মহীতোষবাবু, আপনি বৃথাই দুশ্চিন্তায় ভুগছেন। আমি আপনার শিকারের অক্ষমতা কারুর কাছে প্রকাশ করব না সেটা আমি শশাঙ্কবাবুকে কথা দিয়েছি। আমি ব্যাপারটা অনেক আগে থেকেই সন্দেহ করেছি। লালমোহনবাবুর চিঠিতে আপনার সই দেখে আমি ভেবেছিলাম। আপনি বুঝি বৃদ্ধ। লিখতে গেলে যদি আপনার হাত কাঁপে, তা হলে বন্দুক ধরলে সে হাত স্থির থাকবে কী করে সে চিন্তা আমাকে ভাবিয়ে তুলেছিল। অবিশ্যি এমনও হতে পারে যে, আপনার হাত খুব সম্প্রতি বিকল হয়েছে; বইয়ে যে সব শিকারের কথা লিখেছেন সে-সব আপনিই করেছেন। কিন্তু আমার মনে নতুন করে সন্দেহ ঢুকিয়ে দিলেন। আপনার দাদা। দেবতোষবাবু অসংলগ্ন কথা বললেও তাঁর একটা কথার সঙ্গে আর একটা কথার সরাসরি সম্পর্ক না থাকলেও, তিনি যে আজগুবি মিথ্যে বলছেন এটা কিন্তু আমার কখনও মনে হয়নি। তিনি যা বলছেন তার মধ্যে খুঁজলে অর্থ পাওয়া যায়, এটাই আমার মনে হয়েছিল। আপনি শিকারের বই লিখছেন সেটা নিশ্চয়ই উনি জানতেন, আর আপনি যে এত বড় একটা মিথ্যের আশ্রয় নিয়েছেন তাতে তিনি নিশ্চয় খুবই কষ্ট পেয়েছিলেন। এই মিথ্যে নিয়ে আক্ষেপ আমি দুবার তাঁর মুখে শুনেছি। সবার হাতে হাতিয়ার বাগ মানে না এটাও তিনি–

ফেলুদার কথা বন্ধ করে মহীতোষবাবু চেঁচিয়ে উঠলেন—

বাগ মেনেছিল। সাত বছর বয়সে আমি এয়ারগান দিয়ে শালিক মেরেছি, চড়ুই মেরেছি–পঞ্চাশ গজ দূর থেকে। কিন্তু…

মহীতোষবাবুর দৃষ্টি বুড়ো অশ্বত্থ গাছটার দিকে চলে গেল। তারপর বললেন, এক’দিন চড়ুইভাতি করতে এসে ওই গাছে চড়েছিলাম— ওই ডালে— যেখানে আপনার ভাইটি উঠেছিল। দাদা বলল বাঘ আসছে, আর আমি বাঘ দেখব বলে। লাফ মেরে–

হাত ভাঙলেন?

কম্পাউন্ড ফ্র্যাকচার, এগিয়ে এসে বললেন মহীতোষবাবুর বন্ধু শশাঙ্ক সানাল। কোনও দিনই হাড় জোড়া লাগেনি ভাল করে।

ফেলুদা বলল, কিন্তু বংশের মর্যাদা রক্ষা করার জন্য শিকারি হবার শখ হল? আর নিজের দেশের নিজের জঙ্গলে মিথ্যে ধরা পড়ে যাবে বলে উড়িষ্যা আর অসমের জঙ্গলে শিকার করলেন? আপনি করলেন মানে, করলেন শশাঙ্কবাবু, কিন্তু লোকে বুঝল যে সিংহরায় পরিবারে তিন পুরুষ ধরে বাঘ শিকারের ধারা চলে আসছে। তাই না মহীতোষবাবু?

মহীতোষবাবু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, শশাঙ্ক যা করেছে তার বন্ধুর জন্য, তেমন আর কেউ করে না। ওর মতো শিকারি। আমাদের পরিষ্কারেও কেউ জন্মায়নি।

কিন্তু সম্প্রতি সেই বন্ধুত্বে কি একটু চিড় ধরেছিল?

মহীতোষবাবু আর শশাঙ্কবাবু দুজনেই চুপ করে আছেন দেখে ফেলুদা বলে চলল, বই বেরোবার আগে আমি অন্তত মহীতোষ সিংহরায়ের নাম শুনিনি। কিন্তু বেরোবার পরে আজ হাজার হাজার লোকে তাঁর নাম শুনেছে, এবং একটা বিরাট মিথ্যেকে সত্যি বলে মেনে নিচ্ছে। আসল শিকারি কিন্তু তাঁর ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সেটা কি তিনি খুব সহজেই মেনে নিতে পারছেন? বন্ধুত্বের খাতিরে কতটা আত্মত্যাগ সম্ভব? আপনি সেদিন রাত্রে শশাঙ্কবাবুকেই কথা শোনাচ্ছিলেন না? আমি কি অনুমান করতে পারি যে, বেশ কিছুদিন থেকেই শশাঙ্কবাবু আর আপনার মধ্যে একটা মনোমালিন্য ও কথা কাটাকাটি চলছে?

এখনও দুজনে চুপ। ফেলুদা স্থির দৃষ্টিতে মহীতোষবাবুর দিকে চেয়ে থেকে বলল, মীনং সম্মতি লক্ষণম বলেই ধরে নিচ্ছি। আর, আরেকটা ব্যাপারেও আপনার বোধহয় মীন অবলম্বন ছাড়া রাস্তা নেই।

মহীতোষবাবু ভয়ে ভয়ে ফেলুদার দিকে চাইলেন। ফেলুদা বলল, তড়িৎবাবুর সাহিত্যকীর্তির জন্যই যে আপনি প্রশংসা পাচ্ছেন, সেটাও বোধহয় সত্যি। তাই নয়, মহীতোষবাবু? আপনি সেদিন আপনার পাণ্ডুলিপির কথা বললেন, কিন্তু আমি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও আপনার লেখা একটি টুকরো কাগজও কোথাও পেলাম না। আসলে আপনি লিখতেন না, আপনি মুখে মুখে আপনার মতো করে বলতেন, আর তড়িৎবাবু সেটাকে তাঁর আশ্চর্য সাবলীল ভাষায় সাজিয়ে দিতেন। আর সেই সাজানো লেখা প্রকাশিত হত আপনার নামে। তড়িৎবাবুকে আপনি ভাল মাইনে দিতেন, তাকে আরামে রেখেছিলেন, তোয়াজে রেখেছিলেন এ সবই ঠিক। কিন্তু একজন সত্যিকারের গুণী স্ৰষ্টার পক্ষে ওগুলো যথেষ্ট নয়। মহীতোষবাবু। সে সবচেয়ে বেশি যেটা আশা করে সেটা হল তার গুণের আদর–যেটা না পেয়ে তড়িৎবাবুর মন ক্ৰমে ভেঙে যায়। তারপর সংকেতটা হাতে পড়ে, আর তার সমাধানও হয়ে যায়। নারায়ণী মুদ্রার কথাটা হয়তো তিনি আপনার পরিবারিক কাগজের মধ্যে পেয়েছিলেন। মোট কথা তিনি স্থির করেন যে, গুপ্তধন নিয়ে আপনার কাজে ইস্তফা দিয়ে চলে যাবেন। কিন্তু সে আশা তাঁর পূর্ণ হল না।

মহীতোষবাবু যেন বেশ কষ্ট করেই উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, সবই তো বুঝলাম মিস্টার মিত্তির, এর সবই ঠিক এবং কোনওটাই আমার শুনতে ভাল লাগছে না। কিন্তু তড়িৎকে এভাবে হত্যা করল কে? তার না হয় আমার উপর আক্রোশ ছিল, কিন্তু তার উপর কারও আক্রোশ ছিল বলে তো আমি জানি না। তড়িৎ ছাড়া আর কে এসেছিল সেদিন জঙ্গলে?

কে এসেছিল তা বোধহয় আমি বলতে পারি।

মহীতোষবাবু পায়চারি আরম্ভ করেছিলেন, ফেলুদার কথা শুনে থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন।

পারেন?

ফেলুদার দৃষ্টি ঘুরে গেল।

শশাঙ্কবাবু, আপনি সেদিন রাত্রে ট্রেফি রুম থেকে একটি উইনচেস্টার রাইফেল নিয়ে এই জঙ্গলে আসেননি? কাল রাত্রে ওটার বাঁটে সামান্য একটু মাটি লেগে রয়েছে দেখলাম, যেটা পরশু রাত্ৰে দেখিনি।

শশাঙ্কবাবুর নার্ভ বোধহয় বাঘ শিকার করেই আশ্চর্যরকম শক্ত হয়ে গিয়েছিল। উনি অদ্ভুত ঠাণ্ডাভাবে ফেলুদার দিকে চেয়ে বললেন, যদি এসেই থাকি–আপনি তার কী মানে করতে চাইছেন সেটা বলবেন কি?

ফেলুদাও ঠিক শশাঙ্কবাবুর মতোই শাস্তভাবে বলল, বন্ধু সম্পর্কে আপনার হতাশা জাগিলেও আপনি তার গুপ্তধনের ওপর লোভ করবেন। সেটা আমি মোটেই ভাবছি না। তবে আমার ধারণা, তড়িৎবাবু যে সংকেতের সমাধান করে ফেলেছেন সেটা আপনি জানতেন, তাই না?

শশাঙ্কবাবু বললেন, শুধু তাই না, তড়িৎ গুপ্তধন পেলে তার অর্ধেক আমাকে আফার করেছিল। তড়িৎ বুঝেছিল মহীতোষ আমাদের দুজনকেই একইভাবে বঞ্চিত করছে। কিন্তু আমি তড়িতের প্রস্তাবে রাজি হইনি। শুধু তাই নয়, আমি গুপ্তধনের সন্ধানে এখানে আসতে অনেক বার বারণ করেছিলাম; কারণ ওই ম্যান-ইটার। শেষটায় সেদিন রাত্রে জানালা দিয়ে ওর টর্চের আলো দেখে আমি বন্দুক নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। এখানে এসে দেখি গুপ্তধন পড়ে আছে, কিন্তু তড়িৎ নেই। তারপর অনুসন্ধান করে দেখলাম রক্তের দাগ, বাঘের পায়ের ছাপ। গুপ্তধন মন্দিরের ভিতর রেখে, সেই চিহ্ন ধরে আমি এগিয়ে যাই বাঁশবনের কাছাকাছি পর্যন্ত। বিদ্যুতের আলোতে দেখি বাঘ তড়িতের মৃতদেহের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। অন্ধকারে আন্দাজেই গুলি চালাই। বাঘ পালায়। তারপর…

শশাঙ্কবাবু কেন যেন চুপ করে গেলেন। ফেলুদা বলল, বাকিটা আমি বলি? এটাও অনুমান। ভুল হলে আমাকে শুধরে দেবেন।

বেশ। বলুন।

আপনিই কাল রাত্রে মাধবীলালের সঙ্গে কথা বলছিলেন না?

শশাঙ্কবাবু অস্বীকার করলেন না। ফেলুদা এবার আর একটা প্রশ্ন করল।

সেটা কি মন্দিরের পিছনে বাঘের জন্য টাপ ফেলার প্রস্তাব দিতে? ওই শিমুল গাছটার মগডালে শকুনির পাল দেখে মনে হচ্ছে ওর কাছাকাছি একটা মরা জানোয়ার পড়ে আছে।

মোষের বাচ্চা, চাপা গলায় বললেন শশাঙ্কবাবু।

তার মানে আপনি চাইছিলেন যে আজ বাঘ বেরোক, যাতে আপনি অন্তত একজন বাইরের লোকের সামনে প্ৰমাণ করে দিতে পারেন যে শিকারি আসলে হচ্ছেন আপনি, মহীতোষবাবু নন।

মহীতোষবাবু হঠাৎ ফেলুদার দিকে এগিয়ে এসে কাঁধে হাত দিয়ে অনুনয়ের সুরে বললেন, মিস্টার মিত্তির, আমি আপনাকে একটা অনুরোধ করব, আপনাকে সেটা রাখতে হবে।

কী অনুরোধ?

এই গুপ্তধনের কিছু অংশ আমি আপনাকে দিতে চাই। সেটা আপনাকে নিতে হবে। ফেলুদা মহীতোষবাবুর চোখে চোখ রেখে মৃদু হেসে বলল, রৌপ্যমুদ্রা আমি চাই না মিস্টার সিংহরায়। কিন্তু একটা জিনিস। আমি নেব।

কী জিনিস?

আদিত্যনারায়ণের তলোয়ার।

লালমোহনবাবু কথাটা শোনা মাত্র এগিয়ে এসে ফেলুদার হাতে তলোয়ারটা দিয়ে দিল।

এই তলোয়ারটা আপনি চাইছেন? মহীতোষবাবু অবাক হয়ে বললেন। নারায়ণী রৌপ্যমুদ্রা না নিয়ে ইস্পাতের তলোয়ার নেবেন?

এ তলোয়ারকে আর সাধারণ তলোয়ার বলা চলে না মহীতোষবাবু! এর সঙ্গে ইতিহাস ছাড়াও আরও কিছু জড়িত হয়ে পড়েছে।

আপনি তড়িতের খুনের কথা বলছেন?

না।

তবে?

খুনের কথা বলছি না, কারণ তড়িৎবাবু খুন হননি।

তবে? আত্মহত্যা?

তাও না।

আপনি কি হেঁয়ালি তৈরি করছেন মিস্টার মিত্তির? মহীতোষবাবুর গলার স্বরে বুঝলাম, তার ভিতরের কঠিন মানুষটা আবার বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে।

ফেলুদা বলল, না, তা করছি না, মহীতোষবাবু। যা ঘটেছিল সেটাই বলতে যাচ্ছি। সেটা এত স্পষ্ট বলেই আমাদের দৃষ্টি সেদিকে যাচ্ছিল না। তলোয়ারটা তড়িৎবাবু নিজেই আদিত্যনারায়ণের ঘর থেকে সরিয়েছিলেন।

সে কী, কেন?

কারণ গুপ্তধন পেতে হলে তাকে মাটি খুঁড়তে হবে, আর তার জন্য শাবল জাতীয় একটা কিছুর দরকার। তড়িৎবাবুর হাতের সবচেয়ে কাছে ছিল এই তলোয়ারটা।

তারপর?

তারপর কী–সেটা বলার আগে এই তলোয়ারের একটা বিশেষত্ব আমি আপনাদের দেখতে চাই।

এই বলে ফেলুদা তলোয়ারটা নিয়ে কেন যেন শশাঙ্কবাবুর দিকে এগিয়ে গেল। শশাঙ্কবাবু সাহসী হলেও ফেলুদাকে ওইভাবে অস্ত্ৰ হাতে নিয়ে এগিয়ে আসতে দেখে একটু যেন উসখুসি করে উঠলেন। এবার ফেলুদা এক আশ্চর্য খেল দেখাল। সে তলোয়ারটা শশাঙ্কবাবুর হাতের বন্দুকের নলের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে নিয়ে গেল, আর খুব কাছাকাছি আসতেই একটা খটাং শব্দ করে ইস্পাতে ইস্পাতে জোড়া লেগে গেল।

এ কী, এ মে চুম্বক! বলে উঠলেন শশাঙ্কবাবু।

হ্যাঁ, চুম্বক, বলল ফেলুদা।তলোয়ারটাই চুম্বক, বন্দুকটা না। আগে চুম্বক ছিল না, কারণ আদিত্যনারায়ণের আলমারিতে তলোয়ারের পাশেই আরও ছোটখাটো অনেক লোহা আর ইস্পাতের জিনিস ছিল। চুম্বক হলে তলোয়ার বার করা বা রাখার সময় সেগুলো এর গায়ে আটকে যেত নিশ্চয়ই, কিন্তু যায়নি। এ তলোয়ার চুম্বকে পরিণত হয়েছে। পরশু রাত্রে।

কী করে? জিজ্ঞেস করলেন মহীতোষবাবু; সকলেই রুদ্ধশ্বাসে ফেলুদার কথা শুনছে। ফেলুদা বলল, কোনও মানুষের হাতে লোহা বা ইস্পাতের কোনও জিনিস থাকা অবস্থায় যদি তার উপর বাজ পড়ে, তা হলে সে জিনিস চুম্বকে পরিণত হয়। শুধু তাই নয়, সে জিনিস অনেক সময় বিদ্যুৎকে আকর্ষণ করে। তড়িৎবাবুর মৃত্যু হয়েছিল বজ্ৰাঘাতে, এবং হয়তো এই তলোয়ারই তার মৃত্যুর জন্য দায়ী। মাটি খুঁজে কলসি বার করার পর বৃষ্টি নামে, তার সঙ্গে বাজ ও বিদ্যুৎ। তড়িৎবাবু অশ্বত্থগাছের নীচে আশ্রয়ের জন্য ছুটে আসেন। বাজ পড়ে। তড়িৎবাবু ছিটকে পড়ার সময় তার হাতের তলোয়ার বুকে বিধে যায়। সম্ভবত মৃত্যুর পরমুহূর্তেই তলোয়ার তার দেহে প্রবেশ করে।

মহীতোষবাবুর সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে। তাঁর দৃষ্টি অশ্বত্থ গাছটার দিকে গেল। ভাঙা ভাঙা অস্ফুট স্বরে বললেন, তাই ভাবছিলাম, এই গাছটা হঠাৎ এত বুড়ো হয়ে গেল কী করে?

মহীতোষবাবুর কথার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই লালমোহনবাবু বলে উঠলেন, তড়িৎবাবু শেষটায় তড়িৎপৃষ্ট হয়ে মারা গেলেন!

দুঃখের বিষয় ওঁর এই চমৎকার কথাটায় কান দেবার মতো মনের অবস্থা তখন কারুরই ছিল না।


আমরা আজ কলকাতা ফিরে যাচ্ছি। আজ বাইরে রোদ, দু দিন বৃষ্টি হওয়ার দরুন গরমও কম। আমরা জিনিসপত্র গুছিয়ে ঘরে বসে আছি, মাঝে মাঝে বাইরে থেকে দেবতোষবাবুর গলা পাচ্ছি। সকালে উঠেই দেখেছি ওঁর ঘরের দরজায় আর তালা নেই; গাছ থেকে নামার সময় লালমোহনবাবুর হাঁটু ছড়ে গিয়েছিল। ক্ষতের উপর উনি স্টিকিং প্লাস্টার লাগাচ্ছেন, এমন সময় মহীতোষবাবুর চাকর একটা স্টিলের ট্রাঙ্ক মাথায় করে ঘরে ঢুকে সেটাকে মাটিতে নামিয়ে রেখে বলল, মহীতোষবাবু পাঠিয়ে দিয়েছেন। ফেলুদা সেটা খুলতেই দেখা গোল তার মধ্যে খুব সাবধানে প্যাক করা রয়েছে একটা চমৎকার বাঘছাল। একটা খামও ছিল ট্রাঙ্কটার মধ্যে, তার ভিতরে তিন লাইনের একটা চিঠি—

ডিয়ার মিস্টার মিত্তির, আমার কৃতজ্ঞতার নিদর্শন স্বরূপ এই বাঘছালটি গ্রহণ করিয়া আমাকে বাধিত করিবেন। ১৯৫৭ সালে সম্বলপুরের নিকটবর্তী এক জঙ্গলে আমার বন্ধু শ্ৰীশশাঙ্কমোহন স্যানাল কর্তৃক এই বাঘটি নিহত হইয়াছিল।

লালমোহনবাবু চিঠিটা পড়ে বললেন, দুজনের গুলিতে যেটা মরুল, সেটা কি দু ভাগে ভাগ করা হবে?

ফেলুদা বলল, না। ওটা শশাঙ্কবাবু আমাকেই দেবেন বলেছেন।

ও, তার মানে আপনি একাই…

না, একা না। দুটোর একটা আপনাকে উপহার দেব বলে স্থির করেছি।

উপহার?

উপহার। গাছের ডালে উঠে অজ্ঞান হয়েও যে মাটিতে না পড়ে ঝুলে থাকা যায়, সেইটে সৰ্বপ্রথম আপনিই প্রমাণ করেছেন।

লালমোহনবাবু হাঁ হাঁ করে উঠলেন।

আরে মশাই, আমি তো বলেইছ আমার কল্পনাশক্তিটা সাধারণ লোকের চেয়ে একটু বেশি। আপনারা বলছেন বাঘ, আর আমি দেখছি একটা লেলিহান অগ্নিশিখা, আর তার মধ্যে একটা পৈশাচিক দানব দাঁত খিচুচ্ছে, আর সেই সঙ্গে কৰ্ণপটাহ বিদীর্ণ করা এক হুঙ্কার ছেড়ে একটা জেট প্লেন টেক অফ করছে আমারই উপর ল্যান্ড করবে বলে। এতেও যদি সংজ্ঞা না হারাই তো সংজ্ঞা জিনিসটা রয়েছে কী করতে?